আমার জন্মভূমি হাতিয়া হলেও এসএসসির পর হাতিয়ার বাইরে লেখাপড়া ও চাকরির কারণে কখনও হরিণের অভয়ারণ্য প্রকৃতির নয়নাভিরাম সৌন্দর্যের পটভূমি নিঝুম দ্বীপ যাওয়ার সুযোগ হয়ে উঠেনি! দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রান মন্ত্রনালয়ের একটি প্রকল্পের দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রকৌশলী হিসেবে আমার প্রথম বারের মতো নিঝুমদ্বীপ যাওয়ার সুযোগ হয়।
নিঝুম দ্বীপ বঙ্গোপসাগরের তীর ঘেষে জেগে উঠা একটি ছোট্ট দ্বীপ। এটি নোয়াখালী জেলার হাতিয়া উপজেলার অন্তর্গত। সরকার ২০০১ সালের ৮ এপ্রিল পুরো দ্বীপটিকে জাতীয় উদ্যান হিসেবে ঘোষণা করে।
নিঝুম দ্বীপের পূর্ব নাম ছিল চর-ওসমান, বাউল্লার চর, আবার কেউ কেউ একে ইছামতীর চরও বলত। এ চরে প্রচুর ইছা মাছ (চিংড়ীর স্থানীয় নাম) পাওয়া যেত বলে একে ইছামতির চরও বলা হত।
জনবসতি গড়ে ওঠার একদম শুরুর দিকে এই দ্বীপের নাম ছিল চর ওসমান ও বাউল্লার চর। জনশ্রুতি আছে এখানে বসতি গড়া প্রথম মানুষটির নাম ওসমান। তিনি ছিলেন একজন বাথানিয়া। এই বাথানিয়ার নামানুসারে দ্বীপের নামকরণ করা হয়েছিল।
শুধু সৈকতই নয়, দ্বীপের মাটিও বালুতে চিকচিক করতো। দ্বীপের বিভিন্ন স্থানে দেখা যেতো বালুর ঢিবি বা টিলা। আর এই কারণেই বাইল্যার ডেইল বা বাউল্লার চর শব্দগুলো এই দ্বীপের নামের সঙ্গে জুড়ে যায়। এখনও স্থানীয়রা এই দ্বীপকে বাউল্লার চর নামে চিনে।
প্রথম বসতি গড়ের ওঠার সময় চরে প্রচুর চিংড়ি পাওয়া যেতো। চিংড়ির স্থানীয় নাম ইছা; তাই স্থানীয়দের কেউ কেউ একে ইছামতির চরও বলতো। ১৯৭০ এর ঘূর্ণিঝড়ে দ্বীপটি একদম জনমানব শূন্য হয়ে যায়। সেই সাইক্লোনে অনেক প্রাণহানি ঘটে। ঘুর্ণিঝড় পরবর্তী সময়ে হাতিয়ার তৎকালীন সংসদ সদস্য আমিরুল ইসলাম কালাম দ্বীপটিতে পরিদর্শনে গিয়ে নাম বদলে দ্বীপের নাম নিঝুম দ্বীপ রাখেন।
বাংলাদেশের দক্ষিণের ঠিক শেষ সীমানায় এই নয়নাভিরাম প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভূমির অবস্থান। পর্যটকদের অপার আকর্ষণ ও পর্যটন শিল্প বিকাশে সম্ভাবনা রয়েছে এই দ্বীপটির! নিঝুম দ্বীপের আয়তন ১৬৩.৪৫ বর্গকিলোমিটার। প্রায় অর্ধ লক্ষ লোকের বসবাস এই দ্বীপে। হরিণের অভয়ারণ্য ও মৎস্য বিপ্লবের বিশাল সম্ভাবনা রয়েছে এই দ্বীপটির। দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য যে, দ্বীপের যোগাযোগ ব্যবস্থা খুবই নাজুক! বিগত বছরগুলোতে ফ্যাসিষ্ট জনপ্রতিনিধি জলদস্যুর দুঃশাসনে হাতিয়ার কোথাও উন্নয়নের ছোঁয়া লাগেনি।
হাতিয়ার মুল সড়কটি আমতলী ঘাট পর্যন্ত বিস্তৃত না হওয়ায় চরম ভোগান্তির শিকার হন নিঝুম দ্বীপের মায়াবী আহবানে সাড়া দেয়া ট্যুরিস্টেরা! দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে ভ্রমণ পিপাসুদের প্রথম পছন্দ কক্সবাজার সমুদ্র সৈকতের পর নিঝুমদ্বীপ হলেও যাতায়াত দুর্ভোগ পোহাতে হয় বিধায় পর্যটক বিমুখ হয়ে পড়েছে এই দ্বীপটি।
আর শিক্ষা ব্যবস্থায়ও অনেক পিছিয়ে আছে বাংলাদেশের মুল ভূখণ্ড থেকে বিচ্ছিন্ন এই দ্বীপটি! শুধুমাত্র একটি জুনিয়র হাই স্কুলই এই দ্বীপের অধিবাসীদের উচ্চ শিক্ষার একমাত্র ভরসা! প্রাইমারি শিক্ষা অনেকটা ঘরোয়া পদ্ধতিতে চলছে! দ্বীপ উন্নয়ন সংস্থা কর্তৃক জোনাকী শিক্ষা কেন্দ্রের গৃহীত শিশু শিক্ষা কার্যক্রম সত্যিই প্রশংসনীয়! হাতিয়ার কৃতি সন্তান, বীর মুক্তিযোদ্ধা জনাব রফিকুল আলম সাহেবের উদ্যোগে অজপাড়া গাঁয়ে প্রাথমিক শিক্ষার ছোঁয়া লেগেছে।
আমার ভাবনাঃ
০১) হাতিয়ার নলচিরা সি-ট্রাক ঘাট হতে জাহাজমারা আমতলী ঘাট পর্যন্ত রাস্তাটি আশু সংষ্কার করা হউক। এ বিষয়ে স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর জরুরি পদক্ষেপ এখন সময়ের দাবী।
০২) তমরদ্দি ঘাট-নিঝুম দ্বীপ রূটে পর্যাপ্ত Speed Boat এর ব্যবস্থা রাখতে হবে! যাতে পর্যটকেরা ঢাকা থেকে লঞ্চে তমরদ্দি ঘাটে এসে অনায়াসে নিঝুম দ্বীপ যাতায়াত করতে পারে।
০৩) অনগ্রসর এলাকা হিসেবে নিঝুম দ্বীপের একমাত্র জুনিয়র হাই স্কুলকে অনতিবিলম্বে মাধ্যমিক স্কুল এন্ড কলেজে রূপান্তর করার উদ্যোগ নিতে হবে।
০৪) দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রান মন্ত্রনালয়সহ বিভিন্ন সংস্থা কর্তৃক নির্মিত ” বহুমুখী আশ্রয়কেন্দ্র ও কিল্লা নির্মাণ, সংষ্কার প্রকল্পও শিক্ষা ব্যবস্থার অবকাঠামোগত বিস্তৃতি ও দুর্যোগ মোকাবেলায় অগ্রনী ভুমিকা রাখবে।
আর একটু উদ্যোগই পাল্টে দিতে পারে প্রকৃতির অপার বিস্ময় নিঝুম দ্বীপের পর্যটন সম্ভাবনা।